চাঁদের বুকে পা রাখা প্রথম মানুষ

“একজন মানুষের জন্য এটি একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, কিন্তু গোটা মানবজাতির জন্য এটি একটি বিশাল অগ্রযাত্রা।” গ্রীনউইচ মান সময় রাত ১০:৫৬, আমেরিকার নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং,পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪০,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত চাঁদে প্রথম পা রাখার সময় এই কথাটি বলেন। তার এই উক্তি তখন প্রায় দশ কোটিরও বেশী মানুষ ঘর থেকে শুনছিলো। এর আগে তিনি নভোযান “ঈগল” কে চাঁদের কক্ষপথে অবতরণ করান, এবং চাঁদে প্রথম পা রাখেন।

poat-image

আমেরিকানরা চাঁদে নভোচারী পাঠানো প্রথম শুরু করেন প্রেসিডন্ট জন এফ কেনেডি’র একটি বিখ্যাত আপিলের পর থেকে। আপিলটি তিনি ১৯৬১ সালের ২৫ মার্চ কংগ্রেসের একটি বিশেষ যৌথ অধিবেশনে উত্থাপন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বলেছিলেনঃ “আমি বিশ্বাস করি এই জাতি লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে এবং, এই দশক শেষ হওয়ার পূর্বেই তারা চাঁদে একজন মানুষ প্রেরণ করবে, তারপর তাকে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে।” 

 

সে সময় মহাকাশ গবেষণা নিয়ে আমেরিকার সাথে সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল, যার কারণে আমেরিকার সকল জনসাধারণ কেনেডির এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। 

poat-image

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের একটি দলের সাথে নাসা ( National Aeronautics and Space Administration) দীর্ঘ ৫ বছর কাজ করার পর ১৯৬৬ সালে তাদের প্রথম মিশন পরিচালনা করে, যার নাম ছিল অ্যাপোলো মিশন। তবে, মহাকাশযানে কোন মানুষ ছিলো না। তাদের এই মিশনের পেছনে উদ্যেশ্য ছিল, অবতরণ যান এবং মূল মহাকাশযানের যন্ত্রাংশে কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা খুঁজে বের করা।
  
১৯৬৭ সালের ২৭ শে জানুয়ারীতে ফ্লোরিডার ক্যানাভেরাল এ অবস্থিত কেনেডি স্পেস সেন্টার এ একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। অ্যাপোলো মহাকাশযান এবং স্যাটার্ন রকেট এর একটি মানুষবাহী লঞ্চ প্যাড পরীক্ষা করার সময় সেখানে আগুন লেগে যায়। এই আগুনে তিনজন মহাকাশচারী নিহত হন।  

শত বাধা সত্বেও, নাসা এবং তার হাজারো কর্মচারী সামনে এগিয়ে যান, এবং ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে, অ্যাপোলো ৭ নামে প্রথম মনুষ্যবাহী অভিযান পরিচালনা করে সফল হন। তারা সফলভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণ করেন, এবং চাঁদে প্রবেশ এবং অবতরণ নিয়ে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে, অ্যাপোলো ৮ মিশন পরিচালনা করেন। তারা তিনজন মহাকাশচারী নিয়ে চাঁদের অন্ধকার দিক ভ্রমণ করেন, এবং নিরাপদে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে নাসা প্রথমবারের মত পৃথিবীর কক্ষপথে লুনার মডিউলটি পরীক্ষা করেন। তারপর মে মাসে তিনজন মহাকাশচারী অ্যাপোলো ১০ মহাকাশযান নিয়ে চাঁদের চারপাশে ঘুরে আসেন, জুলাই মাসে চূড়ান্ত ভাবে চাঁদে অবতরণ করার পরিকল্পনা করেন।  

poat-image

জুলাইয়ের ১৬ তারিখ, সময় সকাল ৯ঃ৩২, পুরো পৃথিবী দেখলো, কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তিনজন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন জুনিয়র, এবং মাইকেল কলিংসকে সাথে করে অ্যাপোলো ১১ পৃথিবী থেকে চাঁদের উদ্দ্যেশে উড়ে গেল। ৭৬ ঘন্টায় মোট ২,৪০,০০০ মাইল ভ্রমণ করার পর জুলাইয়ের ১৯ তারিখ অ্যাপোলো ১১ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। এর পরের দিন দুপুর ১ঃ৪৬ এ লুনার মডিউল “ঈগল”-কে নিয়ে আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন মূল মডিউল থেকে পৃথক হয়ে যান। মূল মডিউল বা নভোযান এ তারা কলিংস কে রেখে আসেন। দুই ঘন্টা পর, ঈগল চাঁদের কক্ষপথে ভ্রমণ করে, এবং বিকাল ৪ঃ১৮ সময়ে চাঁদের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবতরণ করে। অবতরণের সাথে সাথে আর্মস্ট্রং টেক্সাস এর হাস্টন এ অবস্থিত তাদের মিশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষে রেডিও বার্তা প্রেরণ করেন। তিনি বলেন “ঈগল এই মাত্র অবতরণ করলো”। 

মূল সময়সূচীর ৫ ঘন্টা আগে, রাত ১০ঃ৩৯ সময়ে আর্মস্ট্রং লুনার মডিউলের দরজা খুলেন। যখন তিনি লুনার মডিউল থেকে চাঁদে নামার জন্য মই নামাচ্ছিলেন, মডিউলে লাগানো টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে সবগুলো দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছিল, এবং সে দৃশ্য পৃথিবী থেকে কয়েকশত মিলিয়ন মানুষ দেখছিল। রাত ১০ঃ৫৬ তে, আর্মস্ট্রং প্রথম চাঁদে পা রাখেন, এবং তার বিখ্যাত উক্তিটি বলেছিলেন, যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন, মাইক্রোফোনের গোলযোগের কারণে তার উক্তিটির কিছুটা বিকৃত শুনা গিয়েছিল। 

তারপর তিনি চাঁদের ধূসর রঙের পাউডারের মত মাটিতে তার বাম পা রাখেন, এবং খুব সতর্কতার সাথে আর এক পা সামনে আগান। এরই মাধ্যমে মানব জাতি প্রথম বারের মত চাঁদে হাটলো।
 
 ১১ঃ১১ সময়ে বাজ অলড্রিন আর্মস্ট্রং এর সাথে চাঁদের ভূপৃষ্টে যোগ দেন, এবং তারা দুজনে মিলে চাঁদের চারপাশের ছবি তুলতে থাকেন, আমেরিকার একটি পতাকা স্থাপন করে, কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, এবং হাস্টোন এ অবস্থিত তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের সাথে কথা বলেন। 

জুলাই এর ২১ তারিখ মধ্যরাত ১ঃ১১ সময় উভয় মহাকাশচারী তাদের লুনার মডিউলে ফিরে যান, এবং মডিউলের দরজা বন্ধ করে দেন। এই দুজন মানুষ সে রাতে চন্দ্রপৃষ্টেই ঘুমান। এবং দুপুর ১ঃ৫৪ বাজে, ঈগল চাঁদ থেকে উড্ডয়ন শুর করে, তারা তাদের মূল মডিউল বা মহাকাশযানে ফিরে আসেন। যাওয়ার আগে তারা চাঁদে একটি ফলক রেখে আসেন, যাতে লিখা ছিলঃ 
“এইখানে পৃথিবী  থেকে আগত মানুষ সর্বপ্রথম পা রাখে - জুলাই, ১৯৬৯ সাল- আমরা এখানে সমগ্র মানজাতির পক্ষ থেকে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছি।”

বিকাল ৫ঃ৩৫ এ আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিং সফলভাবে তাদের মূল মডিউল এ ফিরে আসেন এবং কলিং এর সাথে পুনরায় যোগ দেন, এবং ২২ জুলাই এর মধ্যরাত ১২ঃ৫৬ তে তারা পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেন। জুলাইয়ের ২৪ তারিখ দুপুর ১২ঃ৫১ মিনিট এ তারা প্রশান্ত মহাসাগরে নিরাপদে অবতরণ করেন। 

এরপরেও তারা মোট পাঁচবার সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করেন। এছাড়াও তারা অ্যাপোলো ১৩ নামে একটি অনির্ধারিত মিশনও পরিচালনা করেন। চাঁদে ভ্রমণ করা সর্বশেষ মহাকাশচারী হলে ইউগিনি কারন্যান এবং হ্যারিসন স্মিথ। তারা ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর অ্যাপোলো ১৭ মিশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

অ্যাপোলো প্রোগ্রাম ছিল ব্যয়বহুল এবং ব্যাপক পরিশ্রমসাধ্য। এই ধরনের মিশনের জন্য আনুমানিক ৪,০০,০০০ ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদ, এবং বিজ্ঞানীদের একসাথে কাজ করা লাগত। এবং এই ধরণের একটি মিশন পরিচালনা করার জন্য তখনকার সময়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হত, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও কাছাকাছি। 


কেনেডির ১৯৬১ সালের সংশোধনীতে বলা হয়, তার এই খরচ ন্যায়সঙ্গত ছিল, কারণ এর দ্বারা তারা স্নায়ু যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করেছিল বলে মনে করতেন। এর পরপ অবশ্য চাঁদে অবতরণের অন্যান্য মিশনগুলি তাদের কার্যকারিতা হারায়।

আপনি কি সাহায্য পেয়েছেন

সকল মন্তব্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন নিবন্ধন করুন